কালিম্পং-এ এসেছি ২০th ডিসেম্বর। কবি ও ডা: সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবস্থাপনায় রয়েছি সার্কিট হাউসে৷ এর মধ্যে একদিন মংপু গিয়েছিলাম ৷ ১৯৮৩ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরিবার ও বাবা মা সহ আমি, আমরা মংপু এসেছিলাম চিরদিনের জন্য সেই সময়ের সিনকোনা প্ল্যান্টেশনের ডাইরেক্টরের আতিথেয়তায়৷ সেই স্মৃতি খুঁজতে গিয়ে একটু হতাশই হতে হল৷ সিনকোনা কারখানা বন্ধ, জায়গাটা ঘিঞ্জি হয়ে গেছে৷ আমরা যে ইন্সপেকশন বাংলোয় ছিলাম, সেটা ভেঙে একটা নতুন বাড়ি হয়েছে যা জায়গাটার সঙ্গে বেমানান৷ মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িটি অক্ষত আছে৷ প্রতিবছর নিয়মিত রক্ষণা বেক্ষণও হয়৷
কালিম্পং শহরের কিছুটা উপরে, ডেলোর পাশে একটা নতুন রিসর্ট হয়েছে৷ ইউরু৷ এখানে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর তিস্তা নদী দুটোই দেখা যায়৷ আমাদের এখানে দুদিন থাকার কথা৷ আসার আগে সংহিতা কালিম্পং-এর প্রত্যন্ত একটা জায়গায় এক প্রায় পোড়ো বাড়ির সামনে নিয়ে এল৷ গৌরিপুর হাউস৷ পোড়ো হয়েই পড়ে আছে৷ বাড়িটার সামনে দিগন্ত বিস্তৃত হিমালয় উজার করে দিয়েছে নিজেকে৷
১৯৩৮ সালের এপ্রিলে রবীন্দ্রনাথ প্রথম কালিম্পং-এ আসেন। অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার এক তালুক-এর নাম গৌরিপুর৷ এখানকার জমিদার রায়চৌধুরী পরিবার৷ ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ময়মনসিংহের মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর আতিথ্য গ্রহণ করেন৷ সেই সময় রায়চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হয় ও পরবর্তীতে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের৷ গৌরিপুর হাউস ছিল এই পরিবারের গ্রীষ্মকালীন শৈলাবাস৷ এই পরিবারের বীরেন্দ্রকিশোর চৌধুরীর আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ প্রথম কালিম্পং আসেন ও এই বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন৷ এই বাড়ি থেকেই সেই বছর জন্মদিনে, ‘জন্মদিন’ কবিতাটি আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করেন৷ এই শহরে থাকাকালীন শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও কবি যোগ দেন৷ বিখ্যাত গ্রাহাম্স্ হোমের প্রাণপুরুষ জন গ্রাহামের সঙ্গে কবির সখ্য গড়ে ওঠে৷ এই বাড়িতে থাকাকালীন ‘যক্ষ’ কবিতাটি লেখেন৷ ১৯৪০ সালে মে মাসে রবীন্দ্রনাথ আবার কালিম্পং-এ আসেন, সে যাত্রায় ছিলেন প্রায় মাস দেড়েক৷ এই বাড়ি থেকেই বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রুজভেল্টকে টেলিগ্রাফ করেন তিনি৷ এই বাড়িতে প্রতিমা দেবীও তাঁর সঙ্গে এসে ছিলেন৷ ১৯৪০-এর সেপ্টেম্বরে এখানেই চেয়ার থেকে পড়ে তিনি অসুস্থ হন৷ ২৮ শে সেপ্টেম্বর তাঁকে কলকাতা নিয়ে আসা হয়৷
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত এই ঐতিহাসিক বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল আমাদের ভগ্নদশা সংস্কৃতির-এ এক প্রতিভূ৷ মনটা হু হু করে উঠল৷ সঙ্গে রইল এখনকার গৌরিপুর হাউস আর কবির রোপণ করা বকুল গাছ৷